মানব সভ্যতার অগ্রযাত্রায় বইয়ের ভূমিকা অতুলনীয়। জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে, চিন্তার নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে এই নীরব বিপ্লবী সর্বদা নির্বিকার। ক্ষণস্থায়ী কাগজের পাতায় লেখা কথা, গল্প, কবিতা, বিজ্ঞান, দর্শন; মানুষের চিন্তা ও জ্ঞানের এই অমূল্য সম্পদ ধারণ করে বই কালের সাক্ষী হয়ে টিকে থাকে। আজ আমরা সেই মহান আবিষ্কারের ইতিহাস, বিকাশ ও অনন্য ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করব।
"বই" শব্দটির উৎপত্তি আরবি "বহি" থেকে। ইংরেজিতে এর প্রতিশব্দ "book", যার উৎপত্তি প্রাচীন জার্মান শব্দ "*bōk-" থেকে। মজার ব্যাপার হলো, স্লাভীয় ভাষায় "буква" (বুকভা) শব্দের অর্থ ‘অক্ষর’, যা "বীচ" গাছের সাথে সম্পর্কিত। রুশ, সার্বীয় এবং ম্যাসেডোনীয় ভাষায় "букварь" (বুকভার) বা "буквар" (বুকভার) হলো প্রাথমিক স্কুলের পাঠ্যপুস্তক, যা ছোটদের পড়া ও লেখার মৌলিক শিক্ষা দেয়। এ থেকে ধারণা করা হয়, প্রাচীন ইন্দো-ইউরোপীয়রা বীচ কাঠে লেখালেখি করত। ল্যাটিন ভাষায় "codex" (কোডেক্স) শব্দের অর্থ ছিল ‘কাঠের ব্লক’। বর্তমানে কোডেক্স বলতে বাঁধাই করা, পৃথক পাতাসহ বই বোঝায়।
খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ সালের দিকে মিশরীয়রা প্যাপিরাস নামক এক ধরনের কাগজ আবিষ্কার করে। প্যাপিরাস গাছের কাণ্ড থেকে তৈরি এই কাগজে তারা বিভিন্ন ঘটনাবলি, হিসাব-নিকাশ, ধর্মীয় গ্রন্থ লিপিবদ্ধ করত। গ্রিক এবং রোমানরাও পরে এই প্রযুক্তি গ্রহণ করে।
খ্রিস্টপূর্ব ২৪০০ সালের দিকে চর্ম ব্যবহার শুরু হয়। বাছুর, ভেড়া বা ছাগলের চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে তাতে লেখা হতো। ১০৫ খ্রিস্টাব্দে মোমের উপর লেখার প্রচলন ঘটে। এর পাশাপাশি চীনারা জিনিসপত্র মোড়ানোর জন্য কাগজ ব্যবহার করত। ৬০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে চীনা ও ইউরোপীয়রা লেখার সাথে ছবি ব্যবহার শুরু করে। ৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে চীনে প্রথম ছবিসহ বই ছাপানো হয়।
১২৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে মিশরে এবং ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দের আগে ইউরোপের কিছু স্থানে অক্ষর বসিয়ে বই ছাপানো শুরু হয়। তবে এশিয়ায় তখনও গাছের বাকল, কলাপাতা বা তালপাতায় হাতে লেখা পুঁথির প্রচলন ছিল।
আধুনিক ছাপা বইয়ের জনক জোহান গুটেনবার্গ। ১৪৫৫ সালে তিনি তার আবিষ্কৃত ছাপাখানায় বাইবেল ছাপান। ৪২ লাইনের এই বাইবেল "গুটেনবার্গ বাইবেল" নামে বিখ্যাত। গুটেনবার্গের এই আবিষ্কার মানব সভ্যতার ক্ষেত্রে এক বিরাট পরিবর্তন আনে।
গুটেনবার্গের আবিষ্কারের পর থেকে বই জ্ঞান বিস্তারের প্রধান মাধ্যমে পরিণত হয়। বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, সাহিত্য সহ সকল ক্ষেত্রেই বইয়ের অবদান অস্বীকার করা যায় না। বই কেবল আমাদের জ্ঞান বৃদ্ধি করে না, পাশাপাশি আমাদের চিন্তাশক্তির বিকাশ ঘটায়, মন ও মননকে প্রসারিত করে।
একটি ক্ষুদ্র বীজ যেমন একটি বিশাল গাছে পরিণত হয়ে অসংখ্য ফল ধারণ করে, তেমনি একটি বই পরিণত হতে পারে অসংখ্য মানুষের জ্ঞানের উৎসে। তাই আসুন, আমরা সকলেই বই পড়ি, বইকে ভালবাসি এবং বইয়ের মাধ্যমে আত্মোন্নয়নের পথ সুগম করি।
111 টি প্রশ্ন
113 টি উত্তর
2 টি মন্তব্য
2 জন সদস্য