টেলিপ্যাথি (Telepathy) হলো এক ধরনের মানসিক যোগাযোগ মাধ্যম বা প্রক্রিয়া, যেখানে দু’জন ব্যক্তি কোনো প্রকার শারীরিক বা প্রযুক্তিগত মাধ্যম ছাড়াই শুধুমাত্র মনের মাধ্যমে একে অপরের কাছে তথ্য আদান প্রদান করতে পারে। এটি প্যারাসাইকোলজির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং বহু বছর ধরে বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও সাধারণ মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু প্রশ্ন হলো টেলিপ্যাথি কি আদৌ সম্ভব? নাকি এটি শুধুই কল্পনা?
আপনি যদি X-Men সিরিজ দেখে থাকেন তাহলে টেলিপ্যাথির ধারণা আপনার কাছে অনেকটাই ক্লিয়ার হয়ে গেছে। এই সিরিজের মেইন ক্যারেক্টার "প্রফেসর" একটি হেড ব্যান্ড ব্যবহার করে যেকোনো মানুষের মস্তিষ্ক পড়তে পারে ও তার সাথে যোগাযোগ করতে পারে। এরপর স্টার ওয়ারস এর 'জেডি' এর চরিত্রেও টেলিপ্যাথির ব্যবহার করা হয়।
এসব তো শুধু মুভি বা ফিকশনের কাহিনি। কিন্তু বাস্তব জীবনে বিজ্ঞানীরা টেলিপ্যাথি নিয়ে বহু গবেষণা করেছেন কিন্তু এখনও কোনো স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে আসলেই একজনের মস্তিষ্ক আরেকজনের মস্তিষ্কের সাথে যোগাযোগ করতে পারে কিনা। মানুষের মস্তিষ্ক ও কম্পিউটারের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করার জন্য Brain-Computer Interface (BCI) টেকনোলজি আবিষ্কার হয়েছে কিন্তু Brain-Brain Interface এখনো আবিষ্কার হয় নি।
তাহলে আপনার কি মনে হয় যে এটা অসম্ভব? তাহলে কিছু ঘটনার কথা বলি।
হাভার্ড মেডিকেল স্কুলের ল্যাবে একজন ব্যক্তি তার মস্তিষ্ক এর মাধ্যমে একটি ইদুরের মস্তিষ্কে সিগনাল পাঠানোর মাধ্যমে ইদুরের লেজ নাড়াতে সক্ষম হন। সব থেকে অবাক করার বিষয় হলো তিনি এটি পরীক্ষা করতে গিয়ে ৯৪% সময়ই সফল হন। পরীক্ষাটি এরকম ভাবে করা হয়েছিলো যে, ব্যক্তিটি কম্পিউটারের স্ক্রিনের আলোর দিকে একবার তাকাচ্ছিলো এবং এই তাকানো থেকে একটি সিগনাল পাঠানো হচ্ছিলো একটি আল্ট্রা-সাউন্ড মেশিনে। আল্ট্রা-সাউন্ড মেশিনটি নিম্ন শক্তির আল্ট্রা-সাউন্ট পালস পাঠাচ্ছিলো ইদুরের ব্রেইনে। ইদূরের ব্রেইনের যে অংশ ইদুরের লেজ কন্ট্রোল করে সেই অংশটি এই আল্ট্রা-সাউন্ড পালস রিসিভ করে সেই অনুযায়ী রেসপন্স করতো।
অনেকটা বাইনারি চয়েস বা ইয়েস-নো এর উত্তরের মতো। আলট্রা-সাউন্ড মেশিনটি ইদুরকে বলে দিচ্ছে "লেজ নাড়াতে হবে" অথবা লেজ নাড়াতে হবে না" এরকম।
উপরের ঘটনাইয় আপনার মনে হতে পারে যে, আরে! এটা তো কো-ইন্সিডেন্স হতেই পারে। তাহলে আরেকটা ঘটনা শুনুন। ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের মিগুয়েল নিকোলেলিস দুইটি ইদুরকে একই সাথে সেম কাজ করানোর জন্য দুই ইদুরের ব্রেইনের মধ্যে মটর কর্টেক্সের মাধ্যমে সংযোগ স্থাপন করে। মজার ব্যাপার হলো একটি ইদুর ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনার ডারহাম শহরে আর আরেকটি ছিলো ব্রাজিলের নাটালে।
দুই ইদুরের সামনেই দুইটি করে লিভার রাখা হয়, এই দুইটি লিভারের মধ্যে নির্দিষ্ট একটিতে প্রেস করলে পুরষ্কার হিসেবে একটি ড্রিংক্স বা পানীয় দেওয়া হবে ইদুরকে। পুরষ্কারের লিভার ছিলো Random কিন্তু দুই ইদুরের সামনেই সেম ভাবেই সাজানো ছিল। যখন প্রথম ইদুরটি তার চয়েস সিলেক্ট করে লিভারে প্রেস করে তখন তার মটর কর্টেক্সের ইলেকট্রিক অ্যাক্টিভিটি রেকোর্ড করে সেটিকে একটি সিমপল সিগনালে কনভার্ট করা হয় এবং দ্বিতীয় ইদুরের মটর কর্টেক্সে পাঠানো হয়। তখন দ্বিতীয় ইদুরটি তার চয়েস সিলেকশন করে। এই পরীক্ষার ৬৪% সময়ই ইদুর দুটি একই সাথে পুরষ্কার ওয়ালা লিভারটি প্রেস করতে সক্ষম হয়।
এরকম আরোও অনেক উদাহরণ আছে কিন্তু এর প্রায় সব গুলো পরীক্ষাই উপরের দুইটি পরীক্ষার মতো বাইনারি চয়েসের মতো অথবা ইয়েস-নো। সিম্পল সিগনাল ট্রান্সফারের মতো। কিন্তু যখন বলা হবে আপনি একটি ইদুরকে টেলিপ্যাথির মাধ্যমে বলে দিন "এখন থেকে চলে যাও নাহলে আমি তোমাকে মেরে তাড়িয়ে দিবো"। অথবা আপনি আপনার ভাই বা বোনকে বলছেন "দরজাটি বন্ধ করে দাও"। সেক্ষেত্রে কি হবে?
উপরের উদাহরণ গুলো কিন্তু বাইনারি চয়েসের মাধ্যমে ব্যাখ্যা বা সলভ করা যায় না। এসব কমান্ডের জন্য ব্রেইন থেকে থেকে অনেক জটিল একটি ইলেকট্রিক অ্যাক্টিভিটি রেকোর্ড হবে এবং সেটিকে যদি একটি সিগনালে কনভার্ট করা হয় সেটিও অনেক জটিল হয়ে যাবে। সেটিকে ডিকোড করে আবার অন্য আরেকটি ব্রেইনকে বুঝানো আরও জটিল। এজন্য এখনো এরকম জটিল কোনো পরীক্ষার সফলতার প্রমাণ পাওয়া যায় নি।
কিছু বিজ্ঞানী দাবি করেন যে, কোয়ান্টাম ফিজিক্সের "এনট্যাঙ্গলমেন্ট" (Quantum Entanglement) তত্ত্ব টেলিপ্যাথির ব্যাখ্যা দিতে পারে। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, দুটি কণা একে অপরের থেকে দূরে থাকলেও একইসাথে প্রতিক্রিয়া করতে পারে। কিন্তু এটি মানুষের মস্তিষ্কে প্রযোজ্য কি না তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
আবার অনেকে মনে করেন যে, মা এবং সন্তানের মধ্যেও নাকি টেলিপ্যাথিক যোগাযোগ দেখা যায়। অনেক মা দাবি করেন তারা তাদের সন্তানের কান্না বা discomforting আগে থেকেই টের পান। আবার এমন অনেক গল্পও প্রচলিত আছে যেখানে যমজ ভাই-বোন একজন অন্যজনের বিপদ বা কষ্টের অনুভূতি শেয়ার করে।
মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ "স্টারগেট প্রজেক্ট" নামে একটি গোপন গবেষণা চালায়, যেখানে টেলিপ্যাথি বা রিমোট ভিউয়িং (দূর থেকে দেখার ক্ষমতা) নিয়ে পরীক্ষা করা হয়। যদিও প্রজেক্টটি পরে বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং এর ফলাফল নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
সব মিলিয়ে যদি একটি সিদ্ধান্ত নিতে বলা হয় যে টেলিপ্যাথি আসলেই সম্ভব কিনা তাহলে এই প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে এখনো ধোয়াশা। অনেক অনেক ছোট ছোট পরীক্ষা আছে যেগুলো আসলেই প্রমাণ করে টেলিপ্যাথি আসলেই এক্সিস্ট করে কিন্তু আমরা টেলিপ্যাথির ডিফিনিশন থেকে টেলিপ্যাথিকে যেরকমটা কল্পনা করি অথবা ফিকশনে যেরকমটা দেখে আমরা অভ্যস্থ সেরকম কোনো ঘটনা বা পরীক্ষার প্রমাণ এখনো মিলে নি।
তবে আমি বিশ্বাস করি একদিন হয়তো সম্ভব হবে। নিউরোসায়েন্স যদি Brain-Computer Interface এর মতো টেকনোলজি আবিষ্কার করে অসাধ্য সাধন করতে পারে তাহলে হয়তো একদিন Brain-Brain Interface ও আবিষ্কার হয়ে যাবে। সেইদিনও হয়তো খুব বেশি দূরে নয়।
Sources:
------------------
ℹ️ National Geographic : https://www.nationalgeographic.com/science/article/will-we-ever-communicate-telepathically
ℹ️ CIA : https://www.cia.gov/readingroom/collection/stargate